ডেস্ক নিউজ : শিক্ষকদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়ার প্রশিক্ষণ। সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটি বাদ দিয়ে প্রশিক্ষণের সময়কাল ছিল মাত্র ৭৮ দিন। প্রশিক্ষণের ব্যাচ এক হাজার ১২১টি। প্রতি ব্যাচে প্রশিক্ষণার্থী ছিল ৩০ জন। প্রতিটি প্রশিক্ষণের স্থায়িত্বকাল ছিল ছয় দিন ও ১২ দিন। ভেন্যু সারা দেশে ২০টি। কিন্তু এই সময়সীমাতেও ওই সব প্রশিক্ষণে উপস্থিত ছিলেন এক ব্যক্তি! এ রকম হাজিরা দেখিয়ে তিনি সম্মানী বাবদ গ্রহণ করেছেন ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ টাকা! ‘রোবোটিক দক্ষতার’ এই ব্যক্তি হচ্ছেন প্রফেসর ড. মো. সবুর খান। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ নামের ওই প্রকল্পের পরিচালক। যদিও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে তাঁর ভিন্ন ভিন্ন স্বাক্ষর পাওয়া গেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) তিন সদস্যের একটি কমিটি তদন্ত করে সেখানে প্রকল্পটিতে এ রকম বিস্তর অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়েছে।
সারা দেশের ২০টি ভেন্যুতে গত বছরের ৬ মার্চ থেকে ৩০ জুন অনুষ্ঠিত ওই প্রশিক্ষণে ৩৬টি জেলার ১০০ উপজেলার শিক্ষকরা অংশ নেন।
শুধু প্রশিক্ষণের সম্মানীই নয়, নিয়ম ভেঙে ভেন্যু ভাড়া প্রদান বাবদ সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামে দেখানো হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা। সেই টাকা নিয়মানুযায়ী ব্যাংকেও জমা করা হয়নি। প্রায় সব অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুনের কোনো তোয়াক্কাই করেননি প্রকল্প পরিচালক। তিনি ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ ছাড় করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেও সেটাও মানছেন না। প্রশিক্ষণের জন্য মালপত্র কেনার ক্ষেত্রেও নেই দরপত্রের বালাই। নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার প্রশিক্ষণসামগ্রী। এমনকি প্রশিক্ষণের জন্য যেসব মালপত্র কেনার কাগজপত্র দেখানো হয়েছে, তার সব পৌঁছায়নি প্রশিক্ষণস্থলে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আইসিটি প্রকল্পের বিষয়ে সবেমাত্র আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। এখন নিয়মানুযায়ী এ ব্যাপারে ফাইল চলমান রয়েছে।’
জানা যায়, এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার আইসিটি প্রকল্প শুরু হয় ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুন মাসে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গত অর্থবছর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি হয় মাত্র ৮ শতাংশ। এখনো মূল কাজ শুরু হয়নি। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের এই প্রকল্পে মূলত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ছিল ক্লাসরুম
পরিচালনার বিষয়েই। কিন্তু সেটা না করে আগেই প্রশিক্ষণের নামে টাকা খরচ করা হচ্ছে। আর ব্যবহারিক প্রয়োগ না থাকায় এই প্রশিক্ষণ কোনো কাজেই আসছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সূত্র জানায়, তিন হাজার ৩৪০টি স্কুলের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা আরো প্রায় পাঁচ হাজার বেসরকারি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে প্রকল্পটিতে। কোনো প্রতিষ্ঠান নিজস্ব উদ্যোগে একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা করে থাকলে সে ক্ষেত্রে প্রকল্পের অর্থায়নে আরেকটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করার কথা। প্রতিটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে একটি করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স, মডেম ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও দেওয়ার কর্মসূচি ঠিক করা হয় প্রকল্পে।
কিন্তু প্রকল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে তদন্তে নামে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন আরেক প্রতিষ্ঠান—পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ১৪টি টিটিসি (টিচার্স ট্রেনিং কলেজ), পাঁচটি এইচএসটিটিআই (হায়ার সেকেন্ডারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) এবং একটি বিএমটিটিআইয়ে (বাংলাদেশ মাদরাসা টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) একই সময়ে প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হলেও সব ভেন্যুতে প্রগ্রাম পরিচালক হিসেবে তিনি মাত্র সাড়ে তিন মাসে ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ টাকা সম্মানী গ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে তিনি কখনো প্রধান অতিথি, কখনো বিশেষ অতিথি হিসেবে সম্মানী নিয়েছেন। কিন্তু প্রফেসর সবুর খানের সরেজমিনে কোনো ভেন্যুর কোনো প্রগ্রাম পরিচালনা করার রেকর্ড নেই। তাই ‘প্রাপ্যতা বহির্ভূতভাবে’ তিনি যে সম্মানী নিয়েছেন, তা সরকারি কোষাগারে ফেরতযোগ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিধি অনুযায়ী, ‘কোনো কর্তৃপক্ষ খরচের মঞ্জুরি এমনভাবে প্রদান করবে না, যাতে তার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজের সুবিধা অর্জিত হয়।’
তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, শুধু প্রকল্প পরিচালকই নন, প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশের ২০টি ভেন্যুর প্রধানরা বিধিবহির্ভূতভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ পাবনা টিটিসির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. সুজাউদদৌলা ৩০টি কোর্সের প্রতিটিতে প্রধান কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রশিক্ষণ কোর্সগুলোতে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি, প্রধান কো-অর্ডিনেটর ও মাস্টার ট্রেইনার—এই তিন ধরনের দায়িত্ব পালন দেখিয়ে সম্মানী নিয়েছেন।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রকল্পের ডিপিপিতে (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) প্রশিক্ষণ কোর্সের ভেন্যু চার্জ হিসেবে প্রতিদিন দুই হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেই হিসেবে ভেন্যু চার্জ হিসেবে সরকারি প্রতিষ্ঠানকেই এক কোটি ৮৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভেন্যু সরকারি প্রতিষ্ঠানে হওয়ায় এই টাকা তাদের প্রাপ্য নয়। যদিও ভেন্যু চার্জ হিসেবে প্রাপ্ত টাকা সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যাংক হিসেবে জমা না দিয়ে সরাসরি ব্যয় করেছে।
প্রশিক্ষণের জন্য ম্যানুয়াল, সার্টিফিকেটসহ নানা সামগ্রী কেনাকাটায়ও ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়মানুযায়ী সনদ ও ম্যানুয়াল বাবদ ব্যয় আলাদাভাবে দেখানোর কথা থাকলেও তা হয়নি। বিভিন্ন ভেন্যু থেকে পাওয়া ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৩০ জনের প্রতিটি প্রশিক্ষণ কোর্সের ম্যানুয়াল বাবদ ৯ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণ ব্যাগ বাবদ ৯ হাজার ৬০০ টাকা, প্রশিক্ষণসামগ্রী বাবদ এক হাজার ৮০০ টাকা এবং প্রতি ব্যাচের প্রশিক্ষণসামগ্রী পৌঁছানোর পরিবহন খরচ মোহাম্মদপুরের আনিশা এন্টারপ্রাইজকে পরিশোধ করা হয়েছে। এত বিপুল পরিমাণ টাকার প্রশিক্ষণসামগ্রী সরবরাহ করার জন্য কিভাবে আনিশাকে নিযুক্ত করা হলো তার কোনো রেকর্ড নেই। অর্থাৎ কোনো দরপত্র ছাড়াই দুই কোটি ২৫ লাখ দুই হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ক্রয়কৃত মালপত্রের কোনো স্টক এন্ট্রি করা হয়নি। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণসামগ্রী ভেন্যু কর্তৃপক্ষ না পেলেও বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
জানা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘ক’ শ্রেণির প্রকল্প পরিচালকদের প্রশিক্ষণ, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও গবেষণা ব্যয় বাবদ প্রতি বরাদ্দে ৩০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। কিন্তু ‘ক’ শ্রেণির আইসিটি প্রকল্পে প্রশিক্ষণ খাতে দুটি বরাদ্দ ছাড়া প্রতিটিতেই তিনি ৩০ লাখ টাকার বেশি বরাদ্দ দিয়েছেন। বিধি অনুযায়ী এ ব্যাপারে ওপর মহলকেও অবহিত করেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আইসিটি প্রকল্পের দুজন সহকারী পরিচালক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অনিয়ম-দুর্নীতিতে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরাই সব আর্থিক ব্যয়ের হর্তাকর্তা ছিলেন। প্রতিটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে যোগাযোগ, সম্মানী, মালপত্র কেনাসহ সব ক্ষেত্রেই তাঁদের ভূমিকা ছিল।
জানা যায়, আইসিটি প্রকল্পে আরো বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি করতে তাঁরা ডিপিএম (ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) অর্থাৎ উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান ছাড়া সরাসরি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষা উপকরণ কেনার উদ্যোগ নেন। এতে পছন্দের কিছু প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে ইচ্ছামতো অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে। সে লক্ষ্যে নানা পরিকল্পনাও এরই মধ্যে হাতে নেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবায়নের জোর চেষ্টা চলছে।
প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর ড. মো. সবুর খান বলেন, ‘এখনো মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের উপকরণ কেনার কাজ শুরু হয়নি। তবে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমরা মাল্টিমিডিয়ার উপকরণগুলো কেনাকাটার জন্য প্রস্তাব জমা দিয়েছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ীই কাজ চলছে।’ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং সব ব্যাচের প্রশিক্ষণ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ভেন্যু ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্তাধীন বিষয়ে কথা বলাটা বিধিসম্মত হবে না।’-কালের কণ্ঠ